গত কয়েক বছর ধরে আমাদের চামড়া ও জুতা শিল্পে দক্ষ জনবলের অভাব নিয়ে কম-বেশি আলোচনা চললেও বর্তমানে এই সংকট অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারনেই শুধুমাত্র চামড়া বা জুতা শিল্পে এবছর অনেক ক্রয়াদেশ পাওয়ার খবর আমরা পত্রিকান্তে জানতে পারছি। আমাদের গত কয়েকমাসের রপ্তানির তথ্যেও এই খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। এটা শুধুমাত্র আমাদের সেক্টরেই ঘটছে তা নয়, অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রেও আমরা একই রকম প্রবণতা দেখতে পারছি। স্বাভাবিক কারনেই ফ্যাক্টরিগুলোকে এখন এসব রপ্তানি প্রবাহ বজায় রাখার জন্য অধিকসংখ্যক জনবল নিয়োগ করতে হচ্ছে। এবং এখানেই শুরু হচ্ছে নতুন সংকট। মোটাদাগে তিন ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে –
প্রথমতঃ চাহিদা অনুসারে আমরা জনবল পাচ্ছি না
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের উচ্চশিক্ষার সনদ পাওয়া শিক্ষার্থীরা শিল্পের উৎপাদন, বিপণন পর্যায়ে চাকরি করতে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ থাকে সরকারি চাকরি, ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের কাজ। উচ্চশিক্ষায় অতি ঝোঁকের ফলে উচ্চশিক্ষিতরা কর্মকর্তা পদে চাকরি না পেয়ে বেকার থাকছে, অন্যদিকে শিল্প কারখানাগুলো শ্রমিক সংকটে ভুগছে। আবার এটাও সত্য যে আমাদের এই খাতের বেশিরভাগ কারখানাগুলোর কাজের পরিবেশের কারনেও অনেকে এখানে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। বেশিরভাগ কারখানার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পুরনো ধ্যান-ধারনায় পরিচালিত হয়। যুগের চাহিদা, প্রজন্মদের চাহিদা যেখানে অবহেলিত থাকে।
দ্বিতীয়তঃ যদিও পাওয়া যাচ্ছে, তারা দক্ষ না
দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারনে অবশ্যই কিছু জনবল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাদের দিয়ে কাঙ্ক্ষিত আউটপুট পাওয়া যাচ্ছে না। তারাও ভালো করতে পারছে না। যেহেতু আমাদের শিল্পখাতের বেশিরভাগ কারখানাতে তাদের প্রশিক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নেই, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকেরা তাদের নিজেদের মতো করে কাজ শিখছে এই আশায় যে কিছুটা কাজ শিখে তারা অন্য কারখানায় গেলে সেমি-অপারেটর বা অপারেটরের বেতন পাবে। একটা দুষ্ট চক্রে আমরা আবর্তিত হচ্ছি, কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াচ্ছে না এই ভয়ে যে প্রশিক্ষণ পেলে তারা অন্য কারখানায় চলে যাবে আবার শ্রমিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না বলে বা ক্যারিয়ারের উন্নতি দেখতে পারছে না বলে শুধুমাত্র কারখানা পরিবর্তনকেই নিজের আয় বাড়ানোর উপায় ভাবছে।
তৃতীয়তঃ দক্ষ জনবল পাওয়ার জন্য আমাদের অন্য কারখানা থেকে বেশি বেতনে জনবল নিয়োগ দিতে হচ্ছে যাতে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আমরা প্রতিযোগীতামূলক থাকছি না।
শ্রমবাজারে যেহেতু দক্ষ জনবলের অভাব, আবার আমাদের কারখানা চালানোর জন্য দক্ষ জনবলের প্রয়োজন তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা স্বল্পকালীন সমাধানে যাচ্ছি। অন্য কারখানা থেকে দক্ষ জনবলকে বেশি বেতন দিয়ে নিয়োগ দিচ্ছি। এখানেও নিয়োগকারী এবং দক্ষ জনবল হারানো কারখানাতে দুধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। একঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নিয়োগগুলোর কারনে আমাদের ক্রয়াদেশ নেয়ার সময়ের উৎপাদন খরচের পরিকল্পনা থেকে বেশি খরচ হচ্ছে এবং আমাদের লাভের পরিমান কমে যাচ্ছে। দুইঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের বেতন অনেকদিন ধরে কারখানাতে কাজ করা কর্মীদের থেকে বেশি হয়, ফলে আগের কর্মীগন অসন্তুষ্ট থাকেন এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়। অন্যপক্ষে দক্ষ জনবল হারানো কারখানাগুলো কর্মী হারানোর ফলে সময়মতো শিপমেন্ট দিতে পারে না কিংবা তাদেরও নতুন অদক্ষ বা বেশি বেতনে অন্য কারখানা থেকে দক্ষ কর্মী ভাগাতে হয়। এই চক্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিল্প।
এই অবস্থা তৈরির জন্য আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা আমাদের কর্মীদের মানসিকতাকে খুব সহজেই দায়ী করতে পারি। আমরা খুব সহজেই বলতে পারি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে তার সঙ্গে শিল্প খাতের চাহিদার কোনো সামঞ্জস্য নেই। আবার আমাদের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার আগ্রহ নেই। ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের শিক্ষিতরা ‘হোয়াইট কলার জব’ পেতে চায়। সব কথাই পুরোপুরি সত্য। এটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। কিন্তু সাথে সাথে এই প্রশ্ন কি আমরা নিজেদের করতে পারি –
- আমাদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আমরা কি করছি?
- আমাদের কর্মীরা কেন শুধু অফিসারই হতে চায়?
যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের এই প্রশ্ন করে সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহন করবে তারাই ভবিষ্যতে টিকে থাকবে। সেসব লক্ষণ ইতিমধ্যে আমরা দেখতে শুরু করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মার্ট প্রজন্মকে কর্মী হিসেবে আমাদের সামলাতে হবে। অতএব তাদের থেকে স্মার্ট হওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই।
লেখক:
মিজানুর রহমান